ব্রেলভী সম্প্রদায় : উপমহাদেশের একটি ভ্রান্ত ফেরকা
বহু বাতিল ফেরকার জন্মভূমি এই ভারত উপমহাদেশ। বিশেষ করে ছূফীবাদী মরমীবাদী চিন্তাধারার ফেরকাগুলো এখানকার আর্দ্র জলবায়ুতে আর্দ্র জনমানুষের মননে এক উর্বর ক্ষেত্র পেয়েছে। এসব ফেরকাগুলোর মধ্যে যে কয়েকটি মতবাদ বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে, তার একটি হল ব্রেলভী মতবাদ। বাংলাদেশে তেমন শোনা না গেলেও পাকিস্তান ও ভারতে ব্রেলভী-দেওবন্দী দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের ইতিহাস শতবর্ষের পুরনো। ১৯৯০-২০০০-এর মধ্যে মসজিদ দখল নিয়ে বেশ কয়েকবার তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ২০০১ সালে ব্রেলভী সংগঠন ‘সুন্নী তাহরীকে’র নেতা সালীম কাদরী দেওবন্দী সমর্থিত সিপাহ-ই-ছাহাবা নামক একটি গ্রুপের হাতে নিহত হন। ২০০৬ সালে করাচীতে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনকালে ব্রেলভীদের সমাবেশে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে তাদের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ ব্রেলভীদের ৫৭ জন নিহত হয়। ব্রেলভী মতবাদের জন্ম ১৮৮০ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীতে, আহমাদ রেযা খান (১৮৫৬-১৯২১খৃ:)-এর হাতে। হানাফী মতাবলম্বী এবং ছূফীবাদে বিশ্বাসী এই ফেরকাটির জন্মই ঘটেছে উপমহাদেশে সংস্কারপন্থীদের হাত থেকে সনাতন ছূফীবাদী, মরমীবাদী আক্বীদা-আমলকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। ব্রিটিশ আমলে ‘আশেকে রাসূল’ নামে এই মতবাদটি সমধিক পরিচিত লাভ করেছিল। অবশ্য দলটির চিন্তাধারা পূর্বসূরী ছূফী নামধারী শিরক ও বিদ‘আতী ফেরকাগুলো থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নিম্নে এই ভ্রান্ত ফেরকাটির পরিচিতি ও আক্বীদা-আমল সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল।
নামকরণ :
ব্রেলভী মতবাদের অনুসারীদের কাছে এ দলের নাম ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। নিজেদেরকে তারা সুন্নী ইসলামের অনুসারী প্রমাণ করার জন্য এ নাম ব্যবহার করে। তবে অন্যদের কাছে দলটি ‘ব্রেলভী’ নামেই সমধিক পরিচিত; এ মতবাদের প্রবর্তক আহমাদ রেযা খানের জন্মভূমি রায়বেরেলীর নামানুসারে। এদের বর্তমান নেতা আন-নাওয়ারীর নামানুসারে এদেরকে জামা‘আতে নাওয়ারীও বলা হয়।
দলটির প্রতিষ্ঠাতার পরিচয় :
এই দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা তাকী আলী খান জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীতে। পিতা নকী আলীর কাছে তিনি প্রচলিত দারসে নিযামী ধারার পাঠ গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৮৭৭ সালে জনৈক শাহ আলে রাসূলের নিকট কাদেরিয়া তরীক্বার বায়‘আত নেন ও খেলাফত লাভ করেন এবং ঐ সালেই পিতার সাথে হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কায় গমন করেন। অতঃপর দেশে ফিরে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন এবং ১৮৮০ সালের দিকে তিনি তার শিরকী মতবাদ প্রচার করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে অতিশয় রাসূল প্রেমিক প্রমাণের জন্য নামের পূর্বে ‘আব্দুল মুছতফা’ (মুহাম্মাদ মুছতফার দাস)’ উপনাম ব্যবহার করেন। অনুসারীদের কাছে তিনি ‘ইমাম’ ও ‘আ‘লা হযরত’ নামে পরিচিত হন। তিনি ছিলেন চিররোগা, খিটখিটে মেযাজের পিঠব্যথার রুগী, অত্যধিক রাগী, সুচতুর ও তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। আরবী, উর্দূ ও ফার্সী ভাষায় তার রচিত মৌলিক ও অনুবাদ গ্রন্থ, কবিতাগ্রন্থ ইত্যাদির সংখ্যা ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৯৬০টি বলে কথিত রয়েছে। তবে আল্লামা ইহসান এলাহী যহীর বলেন, বই হিসাবে গণ্য হয় এমন বইয়ের সংখ্যা ১০-এর অধিক নয়। ১৯১২ সালে তার অনূদিত কুরআনের উর্দূ তরজমা ‘কুনূযূল ঈমান ফি তরজমাতিল কুরআন’ প্রকাশিত হয়। তার প্রধান ও সর্ববৃহৎ রচনা হল ‘ফৎওয়া রেযভিয়াহ’ যা ২৭ খন্ডে রচিত ও প্রতিটি খন্ড ১০০০ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট। পরে রেযা ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এটি ৩০ খন্ডে প্রকাশিত হয়। যার পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০,০০০। এছাড়া আনবাউল মুছত্বফা, খালিছুল ই‘তিক্বাদ, মারজাউল গায়ব ওয়াল মালফূযাত প্রভৃতি তার প্রসিদ্ধ রচনা। তিনি কুরআন-হাদীছের গ্রন্থসমূহে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ৮ শতাধিক নাম পেয়েছেন বলে দাবী করেছেন এবং আরো ১৪০০ নাম আবিষ্কার করেছেন। তার অধিকাংশ রচনাতেই রাসূল প্রেমের বন্দনা প্রবল আকারে প্রকাশ পেয়েছে। দেওবন্দী ও ওয়াহ্হাবীরা তার ভাষায়- রাসূল (ছাঃ)- কে যথাযথ সম্মান না দেয়ায় তিনি তাদের তীব্র সমালোচনা ও তিরস্কার করেছেন। অন্যদিকে অবশ্য ক্বাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে তিনি জোর তৎপরতা চালান। বৃটিশ ইন্ডিয়াকে ‘দারুল হারব’ ঘোষণাতে ছিল তার ঘোর আপত্তি। তাই এ দেশে জিহাদ ও হিজরতের বিরোধিতা করেন তিনি। ১৯২১ সালে ৬৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান। রায়রেরেলীতেই তার মাযার রয়েছে।
এ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ :
প্রাক্তন নেতৃবৃন্দ : মুস্তফা রেযা খান, হামিদ রেযা খান, দিদার আলী, নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (১৩০১-১৩৬৫হিঃ) যিনি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন তার নাম দেন ‘জামেআরা নাঈমিয়াহ’, আমজাদ আলী বিন জামালুদ্দীন বিন খোদাবখ্শ (১৩২০-১৩৬৮ হিঃ), হাশমত আলী খাঁ; তিনি ‘নিজেকে কালবে আহমাদ রেজা খান’ নামে অভিহিত করেন, সাইয়েদ সুজাত আলী কাদরী, আহমাদ ইয়ার খান (১৯০৬-১৯৮১হিঃ) প্রমুখ।
বর্তমান নেতৃবৃন্দ : আখতার রেযা খান (ব্রেলভীদের ইন্ডিয়ান গ্রান্ড মুফতী), কামারুয্যামান আযমী, মুহাম্মাদ এমদাদ হোসাইন পীরযাদা, মুহাম্মাদ ইলিয়াস ক্বাদরী (দাওয়াতে ইসলামী’র প্রধান) আমীন মিঞা কাদরী, আহমাদ সাঈদ কাযমী, আবু বকর মুহাম্মাদ (অল ইন্ডিয়া সুন্নী জমঈয়তুল ওলামার প্রধান), মুকাররম আহমাদ (ফতেহপুর মসজিদ, দিল্লী), মুজীব আশরাফ প্রমুখ। এছাড়া বর্তমান পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইউসুফ রাজা গিলানী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমূদ শাহ কোরেশী, বৃটিশ কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারোনেস সাইয়েদা ওয়ারসী ব্রেলভী মতাবলম্বী বলে পরিচিত।
সংগঠনসমূহ :
পাকিস্তান হল বর্তমানে এই মতবাদপন্থীদের মূল কেন্দ্র। সেখানে তাদের কয়েকটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠন রয়েছে। যেমন জমঈয়তে ওলামায়ে পাকিস্তান, জামাআতে আহলে সুন্নাত, দাওয়াতে ইসলামী, সুন্নী তাহরীক প্রভৃতি। ইন্ডিয়াতে মুম্বাইয়ে অবস্থিত রেযা একাডেমী তাদের প্রধান কেন্দ্র। লন্ডনে তাদের ‘বৃটিশ মুসলিম ফোরাম’ ও ‘ওয়ার্ল্ড ইসলামিক মিশন’ নামে দু’টি সংগঠন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ইমাম আহমাদ রেযা একাডেমী’ নামক একটি দাওয়াতী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া ‘দাওয়াতে ইসলামী’ এবং ‘সুন্নী দাওয়াতে ইসলামী’ নামক দু’টি আন্তর্জাতিক দাওয়াতী মিশন তারা পরিচালনা করছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ :
এই মতবাদের অনুসারীরা উপমহাদেশে অনেক খানকা, মাযার ও মাদ্রাসা স্থাপন করেছে। এই মতবাদের প্রবর্তক আহমাদ রেযা খান তার প্রধান কেন্দ্র বেরেলী শহরে ‘জামে‘আ মানযারে ইসলাম’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত মাদরাসায় প্রচলিত ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়। উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের নিকট ফৎওয়া চাওয়া হলে এখান থেকেই তারা ফৎওয়া প্রদান করেন।
এই চিন্তাধারার দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র হল মুরাদাবাদ। ১৩২৮ হিজরী সালে মুহাম্মাদ নাঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী সেখানে দারুল উলূম নাঈমিয়া নামে একটি দ্বীনী শিক্ষাগারের ভিত্তি স্থাপন করেন। অত্র প্রতিষ্ঠান থেকেই উক্ত চিন্তাধারার বিশিষ্ট আলেম-উলামা শিক্ষালাভ করেছেন। পাকিস্তানে উক্ত চিন্তাধারার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের মধ্যে লাহোর, ‘জামে‘আ নাঈমিয়া গাড়হী শাহো’ ও দারুল উলূম হিযবুল আহনাফ উল্লেখযোগ্য। করাচীতে মাওলানা আব্দুল হামীদ বাদাউনী প্রতিষ্ঠিত জাম‘আ তাবলীগিয়াহ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা কেন্দ্র। এছাড়াও লায়ালপুরের মাদরাসা মাযহারুল ইসলাম এবং মুলতানের মাদরাসা আনওয়ারুল ইসলাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এদের উপস্থিতি :
মূলত: ভারত-পাকিস্তানেই এদের সংখ্যাধিক্য। তবে বাংলাদেশ, বার্মা, শ্রীলংকায় এদের অনুসারী সংখ্যা কম নয়। ইউরোপীয় দেশসমূহেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, মরিশাস সহ আফ্রিকার কিছু কিছু দেশে তাদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আর বাংলাদেশের খানকা, মীলাদ, মাযার ও কবরপূজারী অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এই মতবাদপুষ্ট।
ব্রেলভী মতবাদ :
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এই দলটি ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদী’র আন্দোলন, শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ)-এর বংশধর, বিশেষত শাহ আব্দুল আযীয ও শাহ ইসমাঈল শহীদের ধর্মীয় চিন্তাধারা ও উলামায়ে দেওবন্দের আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য জন্মলাভ করে। রাসূল (ছাঃ) প্রেমের আতিশয্য প্রকাশ করতে গিয়ে তারা জঘন্য ধরনের বহু শিরকী ও বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। নিম্নে তার কিছু নমুনা দেয়া হল। -
- তাদের বিশ্বাস হল, রাসূল (ছাঃ) এমন ক্ষমতার অধিকারী, যার মাধ্যমে তিনি সারা দুনিয়া পরিচালনা করে থাকেন। তাদের একজন বড় নেতা আমজাদ আলী ব্রেলভী বলেছেন, ‘রাসূল (ছাঃ) হলেন আল্লাহর সরাসরি নায়েব। সমস্ত বিশ্বজগৎ তাঁর পরিচালনার অধীন। তিনি যা খুশী করতে পারেন এবং যাকে খুশী দান করতে পারেন, যাকে খুশী নিঃস্বও করতে পারেন। তাঁর রাজত্বে হস্তক্ষেপ করা দুনিয়ার কারু পক্ষে সম্ভব নয়। যে তাঁকে অধিপতি হিসাবে মনে করে না, সে সুন্নাত অনুসরণের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে’। আহমাদ রেযা খান ভক্তির আতিশয্যে গদগদ চিত্তে লিখেছেন, ‘ হে মুহাম্মাদ (ছাঃ)! আমি আপনাকে আল্লাহ বলতে পারছি না। কিন্তু আল্লাহ ও আপনার মাঝে কোন পার্থক্যও করতে পারছি না। তাই আপনার ব্যাপারটি আমি আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিলাম, তিনিই আপনার ব্যাপারে সবিশেষ অবগত’ (হাদায়েক বখশিশ, ২/১০৪)।
- তাদের মতে, রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ওলী-আওলিয়ারাও দুনিয়া পরিচালনার কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। আহমাদ রেযা খান লিখেছেন, ‘ হে গাওছ (আব্দুল কাদের জিলানী)! ‘কুন’-বলার ক্ষমতা লাভ করেছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর প্রভুর কাছ থেকে, আর আপনি লাভ করেছেন মুহাম্মাদ (ছাঃ) থেকে। আপনার কাছ থেকে যা-ই প্রকাশিত হয়েছে তা-ই দুনিয়া পরিচালনায় আপনার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। পর্দার আড়াল থেকে আপনিই আসল কারিগর।’
- ব্রেলভীদের বিশ্বাস হল, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নূরের তৈরী এবং তিনি হাযির (সর্বত্র উপস্থিত) ও নাযির (সর্বদ্রষ্টা)। আর সেটা এইভাবে যে, বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে তাঁর রুহানিয়াত (আত্মিকশক্তি) ও নূরানিয়াত বিচ্ছুরিত হয়। এই রুহানিয়াত ও নূরানিয়াতের জন্য স্থানের নৈকট্য-দূরত্বের কোনও তারতম্য নেই। কেননা আলমে খালক্ব (সৃষ্টিজগৎ) স্থানকালের গন্ডিতে আবদ্ধ, কিন্তু আলমে আমর (নির্দেশজগৎ) এই গন্ডি হতে মুক্ত ও পবিত্র। ফলে যুগপৎভাবে বিভিন্ন স্থানে তাঁর উপস্থিতি এবং প্রকাশ্যভাবে জাগ্রত অবস্থায় তাঁর সাক্ষাত লাভে আওলিয়া কেরামের ধন্য হওয়া সম্ভবপর। কারণ তিনি নূর। আর নূর স্বীয় দৃষ্টি শক্তি দ্বারা নিখিল বিশ্ব দর্শন করতে সক্ষম এবং তাঁর পক্ষে বিভিন্ন স্থানে একই সময়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব।
- তাদের মতে, রাসূল (ছাঃ) হলেন গায়েবজান্তা। এমন কি পঞ্চ-গায়েবের মধ্য হতে নানা শাখাগত জ্ঞান আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। রূহের হাক্বীক্বাত ও আল-কুরআনের মুতাশাবিহাত সম্পর্কে তিনি জ্ঞান লাভ করেছেন। ভূত-ভবিষ্যতের যতসব ঘটনা লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত হয়েছে এবং এ ছাড়াও অন্যান্য ঘটনা রাসূল (ছাঃ) অবহিত ছিলেন। আহমাদ রেযা খান লিখেছেন, আল্লাহ আমাদের নেতা, আমাদের অভিভাবক মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে লওহে মাহফূযের যাবতীয় কিছু দান করেছেন’ (খালেছুল ই‘তিক্বাদ, পৃ:৩৩)।
- যেহেতু ব্রেলভীদের মতে, রাসূল (ছাঃ) হাযির-নাযির, আলিমুল গায়েব ও নূর, সেহেতু তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, তাঁকে ডাক দেয়া এবং ইয়া রাসূলাল্লাহ ধ্বনি দেওয়া জায়েয। সাহায্যের জন্য যে ব্যক্তি তাঁকে ডাকে, তিনি তা শ্রবণ করেন এবং তাকে সাহায্য করেন। এজন্য প্রতি ফরয ছালাতের পর তাদের ইমাম ছাহেব সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াত পড়ে ‘ইয়া নবী সালামু আলাইকা’ বলে কোরাস শুরু করেন এবং মুক্তাদীরা সমস্বরে সেই কোরাসে যোগ দেয়।
- তারা মনে করে, এই সাহায্য প্রার্থনার জন্য আহবান করা রাসূল (ছাঃ) ছাড়াও আওলিয়া কিরামের ক্ষেত্রেও বৈধ। পবিত্রাত্মাদের জন্য দর্শন ও শ্রবণে দূরত্ব ও নৈকট্য বরাবর। আওলিয়ায়ে কেরাম আল্লাহর নূর দ্বারা দেখেন। আর আল্লাহর নূরের কোন প্রতিবন্ধক নেই। সুতরাং আওলিয়াদের রূহের কোন পর্দা নাই। সমস্ত জগৎ তাঁদের জন্য একই রকম। আওলিয়াদের কারামাত ও তাঁদের সম্মোহনী শক্তি তাঁদের ইন্তেকালের পরেও যথারীতি বাকী থাকে। মৃত্যুর ফলে তাঁদের উক্ত গুণাবলী বিলীন হয়না। কেননা তারা ইন্তেকাল করেন অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভে স্থানান্তরিত হন মাত্র। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা মৃত্যুবরণ করেন না বা একেবারে শেষ হয়ে যান না। ফলে তাঁদের সাহায্য করার একশভাগ সম্ভাবনা সর্বত্র বিরাজমান থাকে। যা কেবল নিকটতম কিছু লোকের মধ্যে গন্ডিভূত নয়। অতএব সাহায্য প্রার্থনার জন্য তাঁদের আহবান করতে হলে সর্বদা কবরের নিকটে উপস্থিত হওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বরং যেখান থেকেই ডাকা হৌক না কেন তা বৈধ। শুধু তাই নয় তারা এও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ যেহেতু একা, সেহেতু একাই তার পক্ষে পুরো বিশ্বজগত পরিচালনা করা সম্ভব নয়। ফলে তিনি তাঁর বিশ্ব পরিচালনা কাজের সুবিধার্থে আরশে মু‘আল্লায় একটি পার্লামেন্ট কায়েম করেছেন। সেই পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা মোট ৪৪১ জন। আল্লাহ তাদের স্ব-স্ব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। তন্মধ্যে নাজীর ৩১৯ জন, নাকীব ৭০ জন, আওতাদ ৭ জন, কুতুব ৫ জন, আবদাল ৪০ জন এবং একজন হলেন গাওছুল আযম যিনি মক্কায় থাকেন। উম্মতের মধ্যে আবদাল ৪০ জন আল্লাহ তা‘আলার মধ্যস্থতায় পৃথিবীবাসীর বিপদাপদ দূরীভূত করে থাকেন। আর আওলিয়া দ্বারা সৃষ্টজীবের হায়াত, রুযী, বৃষ্টি, বৃক্ষ জন্মান ও মুছীবত বিদূরণের কার্য সম্পাদন করেন। মৃতগণ কবরে শ্রবণ, দর্শন ও উপলদ্ধি করে থাকেন। তাদের শ্রবণ ও দর্শন যদিও সব সময় থাকে, কিন্তু জুম‘আর দিনে তা বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং সাধারণ মৃত ব্যক্তিরাও কোনরূপ ব্যতিক্রম ছাড়া যিয়ারাতকারীদের সাথে কথা বলে।
- ব্রেলভীরা শী‘আদের মত মনে করে যে, ওলীরা মা‘ছূম। তাদের কোন পাপ নেই। তাই শী‘আদের ইমামদের মত তারাও তাদের আওলিয়াদের মাযার তৈরী করে। মাযারে মোমবাতি বা আলোকসজ্জা করে, কবরের উপর ফুল, নকশাদার চাদর ইত্যাদি চড়ায়। তাদের কবরকে ঘিরে তাওয়াফ করে। তারা মনে করে, আওলিয়াদের নযর-নেয়ায দেয়া এবং তাদের কাছে প্রার্থনা করা জায়েয। এমনিভাবে জানাযার ছালাতের পর হাত তুলে দো‘আ করা, ফাতেহা পাঠ করা, তীজা, চল্লিশা ও বার্ষিক ঈছালে ছাওয়াবের অনুষ্ঠান ও উৎকৃষ্ট ভোজের ব্যবস্থা করত: কুরআন খতম করা, কবরের পার্শ্বে আযান দেওয়া, মৃতের কাফনের উপরে কালেমা তাইয়েবা লেখা, শায়খ আব্দুল কাদির জিলানীর স্বরণে ফাতিহা-ইয়াযদাহমের অনুষ্ঠান করা এবং আওলিয়াদের নামে পশু পালন ইত্যাদি শিরকী-বিদ‘আতী কাজকে তারা পরম ছওয়াবের কাজ মনে করে।
- তাদের বিশ্বাস, মৃতের নামে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ছাদাকা করলে মৃতের ক্বাযা ছালাত ও ছিয়ামের জন্য তা কাফফারা হয়ে যায়। এজন্য প্রতি ওয়াক্ত ছালাত ও ছিয়ামের জন্য তারা এক ছা ফিৎরা সমমূল্য অর্থ নির্ধারণ করে।
- তাদের নিকট সবচেয়ে বড় ঈদ এবং বড় উৎসবের দিন হলো ঈদে মীলাদুন্নবী। এই দিন তারা মহা ধুমধামে জশনে জুলূসের আয়োজন করে এবং বিভিন্ন ভক্তিপূর্ণ গান ও আনন্দ-ফূর্তির আয়োজন করে থাকে। আর রাসূল (ছাঃ)-এর নামে মিথ্যা কাহিনী বর্ণনার জন্য এদিন তারা তথাকথিত সীরাত মাহফিলের আয়োজন করে।
- ওলী-আওলিয়াদের মাযারে কথিত ‘ওরস শরীফ’ পালন তাদের জন্য বিরাট আনন্দের উপলক্ষ। এ উপলক্ষে তারা বাৎসরিক বিরাট মাহফিলের আয়োজন করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। এ দিনটিকে তারা পীরের নেক নযর লাভ ও অত্যন্ত ছওয়াব কামাইয়ের দিন বলে মনে করেন। যারা ছালাত, ছিয়াম আদায় করে না তারা এদিনকে তাদের পরিত্যাগকৃত ছালাত, ছিয়ামের জন্য কাফফারা আদায়ের দিবস বা মুক্তি লাভের দিবস মনে করে।
ব্রেলভীদের মূল আক্বীদার ভিত্তি :
তারা হানাফী মাযহাবের অনুসারী। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের মূল সৌধ নির্মিত হয়েছে মূলত: শী‘আ সম্প্রদায় কেন্দ্রিক। ফলে দেখা যায় তাদের আমল-আক্বীদায় শী‘আদের মতবাদের ব্যাপক প্রভাব। আর তারা মূলত: তিনটি বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
(১) প্রাচ্য দর্শন ভিত্তিক মাযহাব, যা দক্ষিণ এশীয় হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট থেকে এসেছে।
(২) খৃস্টানদের নিকট থেকে আগত মাযহাব, যা হুলূল (حلول ) ও ইত্তেহাদ (اتحاد) দু’ভাগে বিভক্ত। হুলূল (حلول) অর্থ ‘মানুষের দেহে আল্লাহর অনুপ্রবেশ’। হিন্দু মতে, নররূপী নারায়ণ।
(৩) ইত্তেহাদ বা ওয়াহাদাতুল উজূদ (وحدة الوجود) বলতে অদ্বৈতবাদী দর্শনকে বুঝায়। যা হুলূল-এর পরবর্তী পরিণতি হিসাবে রূপ লাভ করে। এর অর্থ হল আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া (الفناء في الله)। তাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে অস্তিত্ববান সব কিছুই মূলত আল্লাহরই অংশ। আল্লাহ পৃথক কোন অস্তিত্বের নাম নয়। অস্তিত্ববান সবকিছুতেই তার প্রকাশ নিহিত। এজন্য হিন্দু দার্শনিকগণ ঈশ্বর, মানুষ ও ব্যাঙের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে না পেয়ে বলেন, ‘হরির উপরে হরি, হরি শোভা পায়। হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়’। আর মরমীবাদী বাউল, পীর-ফকীররা বলে, আকার কি নিরাকার সেই রববানা; আহমাদ, আহাদ হলে তবে যায় জানা। মীমের ঐ পর্দাটিকে উঠিয়ে দেখরে মন, দেখবি সেথায় বিরাজ করে আহাদ নিরঞ্জন। অর্থাৎ আল্লাহ ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) এক ও অভিন্ন। ফলে এ আক্বীদার ভিত্তিতে আজকাল মসজিদে, বাসে, রিকশায় সর্বত্র ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’ পাশাপাশি লেখার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়।
কুফরী ফৎওয়া প্রদান :
বাতিলপন্থী মুশরিক ব্রেলভীদের নিকট আহলে সুন্নাতের প্রায় সমস্ত আলেম-ই কাফের। বিশেষ করে ইমাম বুখারী থেকে শুরু করে ইবনু তায়মিয়াহ, ইবনুল ক্বাইয়িম, আব্দুল ওয়াহহাব নাজদী প্রমুখ এবং তাদের অনুসারীগণ তাদের মতে কাফের। উপমহাদেশে ভারতগুরু নামে খ্যাত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী, মিয়াঁ নাযীর হুসাইন দেহলভী প্রমুখ আহলেহাদীছ আলেম-ওলামাগণ এবং দেওবন্দী আলেম-ওলামাগণ ও তাদের অনুসারীবৃন্দ সকলেই তাদের নিকট কাফের। কেননা তাদের মতে এসব আলেমগণ রাসূল (ছাঃ)- কে যথাযথ সম্মান করেন না।
ব্রেলভী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে লাজনা দায়েমার ফৎওয়া :
এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ফৎওয়া বোর্ড লাজনা দায়েমা থেকে ফৎওয়া দেয়া হয়েছে, এ ধরনের কুফরী আক্বীদাসম্পন্ন লোকের পিছনে ছালাত আদায় করা যাবে না। যদি তারা মূর্খ হয়, তবে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় তাদের পরিত্যাগ করে আহলে সুন্নাতের কোন মসজিদে ছালাত আদায় করতে হবে (ফৎওয়া নং ৩০৯০, ২/৩৯৪-৩৯৬ পৃ:)।
পরিশেষে বলা যায়, ব্রেলভী মতবাদ উপমহাদেশে পীর-মাযারী সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে শিরক ও বিদ‘আতের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। এই মুশরিক দল ও তাদের বিভ্রান্ত আক্বীদা থেকে নিজেদের হেফাযতে রাখা এবং অন্যদেরকে বিশেষত: সাধারণ মানুষকে এদের খপ্পর থেকে রক্ষা করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। আমীন!!
তথ্যসূত্র :
(১) আল্লামা ইহসান এলাহী যহীর, আল-ব্রেলভিয়া : আক্বায়েদ ওয়া তারিখ (লাহোর: ইদারাতু তরজুমানিস সুন্নাহ, ১৯৮৪, ৬ষ্ঠ প্রকাশ)।
(২) সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ ১৬ খন্ড (১ম ভাগ), (ইফাবা : ১৯৯৫) পৃ: ৫৩৬।
(৩) ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, প্রবন্ধ : মা‘রেফাতে দ্বীন, মাসিক আত-তাহরীক (২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, জানুয়ারী’৯৯), পৃ: ৩।
(৪) সম্পাদনা পরিষদ, সম্পাদক : ড মানে‘ আল জুহানী, আল মাওসূআহ আল-মুয়াসসারাহ ফিল আদয়ান ওয়াল মাযাহেব ওয়াল আহযাব আল মুআছারাহ, প্রকাশক : ওয়ার্ল্ড মুসলিম এসেম্বলী (ওয়ামী)।